top of page
  • Writer's pictureindianbengalisinuk

Charuibhati

বাঙালির জীবনে বারো মাস কাটে তের পার্বণ নিয়ে। কোনও মাস বা ঋতু বাঙালি

ঘরে বসে কাটায় না সেই অর্থে । তবে লক্ষ্মীপূজার পরে সরস্বতী পূজা অবধি

অপেক্ষাটা দীর্ঘ এবং মোচ্ছব-প্রিয় বাঙালির কাছে এই অপেক্ষা অসহনীয়।

তায় আবার শীতকাল। গরমের দাবদাহের শেষে পথঘাটে সবে রহস্যময় কুয়াশা

নেমেছে! এমন সময় কি বাড়ি বসে থাকলে চলে ! অগত্যা ‘চড়ুইভাতি’ !



কিন্তু আমরা যারা ৭০০০ মাইল দূরত্বে যুক্তরাজ্যে ঘর বেধেছি , আমরা

অর্থাৎ ‘Indian Bengalis in UK (IBUK)’, আমাদের কাছে তো শীতকাল মানে

এক চিলতে দিন আর উত্তরমেরু ঘেঁষে বয়ে আসা হিমেল বাতাস, রুক্ষ, শুষ্ক,

মলিন ! কিন্তু রক্তে যখন বাঙ্গালিয়ানা তখন চড়ুইভাতির মত একজোট

হওয়ার সুযোগ আমাদের জীবন থেকেই বা বাদ যায় কেন! তাই ভৌগলিক কারণে

বদলে ফেলা প্রিয় ঋতু গ্রীষ্মকালের এক সকালে ৮০ জন বাঙালি মিলে বেরিয়ে

পড়লাম হান্টিংডনের হিচিংব্রুক কান্ট্রি পার্কের উদ্দেশ্যে।



চড়ুইভাতির ইংরেজী সংস্করণ পিকনিক কিংবা বারবিকিউ পার্টি। এখানকার

উপমহাদেশীয়রা মূলত সেই কায়েদা গ্রহণ করে নিয়েছে বহুকাল ধরে। কিন্তু

IBUK বরাবরের মতই এবারেও ঠাহর করল যে চড়ুইভাতি হতে হবে ঠিক

যেমনটা বাঙালিরা বোঝে। অর্থাৎ কোনও কেটারার আমাদের খাবার যোগাবে

না, দোকান থেকে প্যাক করে খাবার যাবে না, বারবিকিউ তেও রান্না হবে না ।

তবে ? এই দেশে এমন নজির খুব কম কিংবা এতবর প্রেক্ষাপটে হয়ত নেই

বললেও চলে। এমনকি বঙ্গদেশেও আজকাল আর কেউ এত ঝামেলা মাথা পেতে

নেয় না। মাঠে হাঁড়ি পেতে, আগুন জ্বেলে সকলে মিলে পঞ্চপদে রন্ধন ক্রিয়া !

অনেকেই শুনে বলেছিল ‘অসম্ভব! যা খুশি তাই বলেলই হল ! অনুমতি মিলবে না !’

হ্যাঁ সত্যি ! অনুমতি মেলা হল ভার। এদিকে চড়ুইভাতির খবর ঘোষণা করতেই দু

দিনে আমাদের তালিকা ভর্তি। এমনকি ওয়েটিং লিস্টেও জড় হলেন প্রচুর

উৎসাহী সদস্য। সেই সময় আমাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩,৯০০। তার মধ্যে

থেকে আমরা নিয়ে যেতে পারব কেবলমাত্র ৮০ জনকে, কারণ কোনও পার্কেই

আমরা তার বেশি লোকের কথা বললে ঠাই পাব না । স্বাভাবিকভাবেই আমাদের

তালিকাগ্রহণ বন্ধ করে দিতে হল দু দিনের মাথায়। প্রায় ৩০ জনের ওয়েটিং

লিস্ট তৈরি হল। এদিকে অনুমতি পাওয়া নিয়ে আমাদের পিকনিক বন্ধ হওয়ার

জোগাড়। একেবারে গ্যাস জ্বালিয়ে রান্নার কথা শুনে কর্তৃপক্ষরা পিছিয়ে যেতে

লাগলেন, এদিকে মানুষের উদগ্রীব লাইন তৈরি হয়ে গিয়েছে, জমা পরে গিয়েছে

অনুদান। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম বাঙ্গালিয়ানা বাদ দিয়ে চড়ুইভাতি নয়।

আমরা নিজেরাই রাঁধব। মিতান - কলি সরকার দম্পতি, ঊষা দত্তর মত সদস্য

থাকতে আমাদের এই বিপদ বেশিদিন টেকেনি। স্থান, কাল, পারমিশান সমস্ত

ঠিক হল। আমরা চললাম গন্তব্যের পথে।



কিন্তু এমন আকারের সাহসিকতা দেখাতে প্রয়োজন সমান আকারের

পরিকল্পনা ও আয়োজন। অন্বেশা, মহাশ্বেতা, বহ্নি, ত্রৈলোক্য, রহমান ,

রিয়াদের সব কাজকম্ম ফেলে চড়ুইভাতির মিটিং করা থেকে শুরু করে জুতো

সেলাই, চণ্ডীপাঠ সবকিছুর জোগাড়যন্ত্র, বাজারহাট – সে যেন এক

মহোৎসবের আয়োজন ! সর্বোপরি আমাদের অধিনায়িকা ডালিয়ার

তত্ত্বাবধান, টাকা-পয়েসার জটিল হিসেবনিকেশ আমাদের এনে দাঁড় করাল

চড়ুইভাতির প্রাক্কালে ! মোক্ষম চালটা নিজে হাতে দায়িত্ব নিল ৫ মহারথী।

মিতান, কলি, বহ্নি, ত্রৈলোক্য মিলে দাঁড়িয়ে থেকে কাটিয়ে আনল ২৫ কিলোর

রেয়াজি পাঠা। সারারাত চলল তার সাজগোজ, মাহেন্দ্রক্ষণের অন্তিম

আয়োজন !



১৩ই জুলাই সক্কাল সক্কাল রহমানের নিপুণ তত্ত্বাবধানে হাজির হল

পিকনিকের বাস ! হ্যা ঠিক পড়েছেন ! আমরা কিচ্ছু ছাড়িনি । বাঙালি যাবে

পিকনিকে আর বাস থাকবে না ! সে আবার কোন কথা বাপু !

অঙ্কুর সবার আগেই পৌঁছে গেছিল রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে। বিলেতের মাঠে

বসল গ্যাসের বিশাল স্টোভ, সঙ্গে বসল দৈত্যাকার হাঁড়ি করাই !

একে একে ক্রমশ হিচিংব্রুক উদ্যান ভরে উঠল আড্ডায়, গল্পে,

কুচোকাচাদের কলরোলে, হাসিতে, গানে, নাচে !



সঙ্গে চলল শর্মি, তপস্যা, অদিতি, ডালিয়া, পারমিতা, রিম্পার লুচি ভাজা, পাশে

চলল কলির আলুর সবজি। লুচি, আলুর তরকারি, জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট

সেরে, চা খেয়ে, কেউ লেগে গেল ফুটবল খেলতে, কেউ মেতে উঠল বহ্নির সাথে

ডামশারাড আর বাকিরা বসে গেলেন নতুন পাওয়া বন্ধুদের সাথে জটলা করে

আড্ডা দিতে। আর এইসবকিছু অন্বেশার অক্লান্ত হাতে ক্যামেরা বন্দি হয়ে

চলল।

এই সময় একদল সবকিছুকে পাশে রেখে সমান হুল্লোড়ে লেগে পড়ল

মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনে। নির্মাল্য, অসিত, সৌম্যাশিশ রা দৌড়াদৌড়ি করে

রান্নার জলের ব্যবস্থা করলো। শ্রাবন্তী, মহাশ্বেতা, রাজীব, রিয়া হাত

লাগাল পাচমেশালি সবজি, কড়াইশুঁটি দিয়ে ভাজা মুগ ডাল রান্নায়, শ্রাবন্তী

দ্বায়িত্ব নিয়ে বানালো খেজুর আমসত্ত্ব -র চাটনি, তেলে পড়ল বেগুনি, ছুড়িতে

পড়ল সালাড। এবং তার পাশে বিরাট খুন্তি হাতে শুরু হল ত্রৈলোক্য ও রাহুলের

পাঁঠার সাথে মল্লযুদ্ধ।





কিছুক্ষণ পরে সাধুবাদ দিতে দিতে সকলে যাচাই করে চেটেপুটে শেষ করলেন

ভাত, ডাল, বেগুনি, স্যালাড, সবজি, মাংস, চাটনি এবং জিভে জল আনা মালাই

চমচম। খাওয়া শেষ হলেও যেন সেই কার্নিভাল আর শেষ হয়না। কেউ গানের

সাথে শরীর দুলিয়েছে, কেউ সুরের সাথে গলা। হাসিতে আর ঝলমলে মুখে ছয়লাপ

চারদিক।



বৈকালিক চায়ের সাথে হৈহল্লা ক্রমেই এক সময় শেষ হয়ে এলো, এক

অবিস্মরণীয় দিনের শেষে সন্ধ্যা নেমে এলো। বিলিতি জীবনের এক অন্যতম

শ্রেষ্ঠ স্মৃতি নিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু কাজ এখনও শেষ হয়নি।

শুরু হল আরেক যুদ্ধের, সাফাই যুদ্ধ। এবং সেই যুদ্ধের শেষে উদ্যান দেখে আর

বোঝার জো নেই যে এইখানেই গত ৯-১০ ঘণ্টা ধরে ঘটে গিয়েছে এক মহোৎসব

! গোটা অনুষ্ঠানে কোনরকম প্ল্যাস্টিক জাতীয় পদার্থ ব্যাবহার না করে,

কোনদিকে এক ফোঁটা আবর্জনা না রেখে আমরা বিদায় জানালাম হান্টিংডনকে।

বিদেশের মাটিতে বাসে করে দল বেঁধে আগুণ জ্বালিয়ে পাঁঠার মাংস রান্না করে

IBUK জানান দিল এক নতুন বাঙ্গালিয়ানার, যা যুগের সাথে, জায়গার সাথে

মানিয়ে নিয়ে বিবর্তিত হবে ঠিকই কিন্তু পাল্টে যাবে না, এগিয়ে যাবে কিন্তু

মিলিয়ে যাবে না। ক্রিসমাস, গুড ফ্রাইডে আর বারবিকিউ পার্টির পাশে সমান

দৃঢ়তায় চলবে দুর্গাপুজো, নববর্ষ আর চড়ুইভাতি !

45 views0 comments

Recent Posts

See All
bottom of page